খনিজ তেল (Petroleum)
উৎপত্তি: প্রায় 7-৪ কোটি বছর পূর্বে আণুবীক্ষণিক ব্যাকটেরিয়া, সামুদ্রিক প্রাণী, উদ্ভিদ কোশ প্রভৃতি টার্সিয়ারি যুগের পাললিক শিলাস্তরের মধ্যে চাপা পড়ে এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া, তাপ ও চাপের প্রভাবে কার্বন ও হাইড্রোজেন মিশ্রিত যে যৌগ তৈরি হয়, তাকে পেট্রোলিয়াম বলা হয়।
খনিজ তেলর প্রাপ্যতা :
খনিজ তেল প্রধানত সচ্ছিদ্র প্রকৃতির বেলেপাথরে সঞ্চিত থাকে। ভূ-অভ্যন্তরে জল, তেল ও গ্যাস-এই তিনটি স্তরের অবস্থান লক্ষ করা যায়। জল ভারী হওয়ায় নীচে এবং তার ওপরে তেল ও গ্যাস অবস্থান করে। খনিজ তেল প্রধানত-① চ্যুতিরেখা অনুসারে, ② ভাঁজের ঊর্ধ্বভঙ্গে, ও শিলাস্তরীয় অসংগতি তল অনুসারে, ④ লবণ গম্বুজের প্রান্তভাগ বরাবর-এই চার প্রকার ভূতাত্ত্বিক গঠনে সঞ্চিত থাকে।
খনিজ তেলর অন্যান্য নাম:
খনি থেকে সংগ্রহ করায় পেট্রোলিয়ামকে খনিজ তেল বলে। পেট্রোলিয়াম শব্দটি মূলত লাতিন শব্দ 'Petra' (যার অর্থ শিলা) এবং 'Oleum' (যার অর্থ তেল)-এর সমন্বয়ে গঠিত। পেট্রোলিয়াম উত্তোলনের সময় এর বর্ণ থাকে তেল মিশ্রিত কাদামাটির মতো কালো বা গাঢ় খয়েরি, যা অপরিশোধিত তেল (Crude Oil) নামে পরিচিত।
কার্বন (প্রায় 87%-90%) ও হাইড্রোজেন (প্রায় 10%-15%)-এর সংমিশ্রণে তৈরি হওয়ায় খনিজ তেলকে হাইড্রোকার্বনও বলা হয়। আধুনিক সভ্যতায় খনিজ তেলের বহুমুখী ব্যবহার ও গুরুত্বের ভিত্তিতে একে তরল সোনা (Liquid Gold) বা কালো সোনা (Black Gold) নামে অভিহিত করা হয়।
খনিজ তেলর প্রকারভেদ:
অপরিশোধিত খনিজ তেল প্রধানত তিন প্রকার। যেমন-
অ্যাসফাল্টবিশিষ্ট তেল (Asphalt- Base Oil): এই তেল অ্যাসফাল্ট যুক্ত, ভারী হাইড্রোকার্বন দ্বারা গঠিত, কালো বর্ণের, বাণিজ্যিক ব্যবহার কম। • প্যারাফিনবিশিষ্ট তেল (Paraffin-Base Dil): এই তেল সবুজ বর্ণের, হালকা হাইড্রোকার্বন দ্বারা গঠিত, বাণিজ্যিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ (পেট্রোল উৎপাদনকারী)। মিশ্র তেল (Mixed-Base Oil): ভারী ও হালকা তেলের মধ্যবর্তী অবস্থা, জ্বালানি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ প্রচুর মাত্রায় ন্যাপথা মিশ্রিত।
উপজাত দ্রব্যসমূহ: অপরিশোধিত তেলকে পরিশোধন করার সময়ে বিভিন্ন দ্রব্য পাওয়া যায়, যেগুলিকে উপজাত দ্রব্য বলে। যেমন-ন্যাপথা, প্যারাফিন, পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাসোলিন, মোম, অ্যাসফাল্ট, কেরোসিন, প্রোপেন, ইথিলিন, লুব্রিকেটিং অয়েল, ভেসলিন প্রভৃতি।
খনিজ তেলের অর্থনৈতিক তাৎপর্য (Economic Significance of Pe-
troleum): বর্তমানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খনিজ তেলের ভূমিকা অপরিহার্য। কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, গৃহস্থালি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে খনিজ তেলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তি তৈরি করে খনিজ তেল। খনিজ তেলের প্রধান অর্থনৈতিক তাৎপর্যগুলি হল- আধুনিক শিল্পে: পেট্রোরসায়ন শিল্প, প্লাস্টিক শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, কৃত্রিম রবার উৎপাদন, রান্নার গ্যাস উৎপাদন, প্রসাধনী দ্রব্য উৎপাদন প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পে খনিজ তেল থেকে প্রাপ্ত দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। কৃষিকাজে: কৃষিক্ষেত্রে পাম্প, ট্র্যাক্টর, হারভেস্টর প্রভৃতি ডিজেল ও কোরোসিনের সাহায্যে চালানো হয়। তা ছাড়া কৃষিকাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সার উৎপাদনেও খনিজ তেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পরিবহণ ব্যবস্থায়: সড়কপথ, রেলপথ ও জলপথে বিভিন্ন যানবাহনকে সচল করার জন্য খনিজ তেলজাত দ্রব্য, যেমন-ডিজেল, পেট্রোল প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে: দেশের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে ট্যাংক, জাহাজ, বিমান প্রভৃতি চালু রাখতে এবং বিস্ফোরক দ্রব্য প্রস্তুতের ক্ষেত্রে খনিজ তেলের ভূমিকা অপরিহার্য। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লার অভাবে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ডিজেল ব্যবহার করা হয়। ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। যন্ত্রের সচলতা বজায়: শিল্প ও পরিবহণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতিকে সচল রাখার জন্য খনিজ তেলজাত লুব্রিকেটিং অয়েল ব্যবহার করা হয়। জীবিকার সংস্থান বৃদ্ধি: খনিজ তেলের ওপর নির্ভর করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহুবিধ শিল্প, বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রভৃতি গড়ে উঠেছে, যেখানে বহু মানুষ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে: খনিজ তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি উদ্বৃত্ত তেল বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। অন্যদিকে খনিজ তেলের ওপর ভিত্তি করে গঠিত বিবিধ অর্থনৈতিক কার্যাবলি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত সুদৃঢ় করে। অন্যান্য: রং, পিচ, বার্নিশ প্রভৃতি উৎপাদনে এবং ঘরে জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
পৃথিবীতে খনিজ তেলের বণ্টন (World Distribution of Petroleum): U.S. Energy Informa- tion Administration-এর তথ্য অনুসারে 2016 খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে খনিজ তেল উৎপাদনের পরিমাণ গড়ে 80,622,000 ব্যারেল/দিন, যার 68% তেল উত্তোলন হয় রাশিয়া, সৌদি আরব, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইরাক, ইরান, চিন, কানাডা প্রভৃতি দেশগুলি থেকে। পৃথিবীর খনিজ তেল উৎপাদক অঞ্চল প্রধানত চারটি বলয়ে বিভক্ত- দূরপ্রাচ্য বলয়: চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান, মায়ানমার প্রভৃতি। ইউরোপীয় বলয়: রাশিয়া, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য, বুমানিয়া, জর্জিয়া, নরওয়ে প্রভৃতি। মধ্যপ্রাচ্য বলয়: সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, ওমান প্রভৃতি। • পশ্চিম বলয় বা আমেরিকান বলয়: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা প্রভৃতি।
ভারতে খনিজ তেলের বণ্টন : 2017 খ্রিস্টাব্দে ভারতে খনিজ তেল উৎপাদনের পরিমাণ হল প্রায় 2938.85 ট্রিলিয়ন মেট্রিক টন যা 2016 খ্রিস্টাব্দের উৎপাদনের তুলনায় প্রায় 0.62% কম। অন্যদিকে 2015 খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে খনিজ তেলের সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রায় 763.48 মিলিয়ন টন। সঞ্চয় ও উৎপাদনের পরিমাণ কম হওয়ায় ভারতকে প্রত্যেক বছর সৌদি আরব, রাশিয়া, কুয়েত, ইরান প্রভৃতি দেশ থেকে প্রচুর অর্থব্যয় করে খনিজ তেল আমদানি করতে হয়। 2015 খ্রিস্টাব্দে ভারতের খনিজ তেল আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় 163 মিলিয়ন টন।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহ: খনিজ তেল উৎপাদনে পৃথিবীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলি হল-দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর; আফ্রিকার গ্যাবন, নাইজেরিয়া, লিবিয়া; অস্ট্রেলিয়ার উইথনেল বে: ইউরোপের আজারবাইজান, ফ্রান্স: এশিয়া মহাদেশের অন্তর্গত মালয়েশিয়ার সাবা, সারাওয়াক; মায়ানমারের চিন্দুইন ও ইরাবতী নদী উপত্যকা অঞ্চল প্রভৃতি।
বাণিজ্য: আমদানিকারক দেশসমূহ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জাপান, কোরিয়া, ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইটালি প্রভৃতি প্রধান খনিজ তেল আমদানিকারক দেশ।
রপ্তানিকারক দেশসমূহঃ সৌদি আরব, রাশিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, নাইজিরিয়া, কুয়েত, মেক্সিকো, ইরাক প্রভৃতি প্রধান খনিজ তেল রপ্তানিকারক দেশ।