বিশ্লেষক বচন
আমাদের সমস্তপ্রকার জ্ঞান প্রকাশিত হয় বাক্য বা বচনের মাধ্যমে। আমরা যাকে বৈয়াকরণিক অর্থে বাক্য বলি, তাকেই তর্কবিজ্ঞানসম্মত অর্থে বচন বলা হয়। বচনকে তাই জ্ঞানের প্রকাশকরূপে উল্লেখ করা হয়। প্রত্যেকটি বচন তাই জ্ঞানের মাধ্যমে পাওয়া একটি তথ্যকে উল্লেখ করে। বচনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভক্ত করা হয়। একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বচনকে দু- ভাগে বিভক্ত করা হয়েছেㅡ[1] বিশ্লেষক বচন (analytic proposition), এবং [2] সংশ্লেষক বচন (synthetic proposition)।
প্রত্যেকটি বচনেই একটি উদ্দেশ্য পদ এবং একটি বিধেয় পদ থাকে। উদ্দেশ্য পদ সম্পর্কে বিধেয় পদে কিছু বলা হয় বা ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিধেয়তে যা ঘোষণা করা হয় তা নতুন কিছু হতে পারে, আবার নতুন কিছু না-ও হতে পারে। যদি বিধেয়টি নতুন কিছু না হয় তাহলে উদ্দেশ্যের ধারণার মধ্যেই বিধেয়ের বিষয়টি নিহিত থাকে। অর্থাৎ, সেক্ষেত্রে উদ্দেশ্যকে বিশ্লেষণ করলেই বিধেয় পদটি পাওয়া যায়। বিধেয়টি তাই এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যের বিশ্লেষকরূপেই গণ্য, নতুন কোনো তথ্যরূপে গণ্য নয়। এই ধরনের বচনগুলিকে বলা হয় বিশ্লেষক বচন।
সংজ্ঞা: যে বচনের বিধেয়ের ধারণাটি উদ্দেশ্যের ধারণার মধ্যে নিহিত থাকে এবং উদ্দেশ্যকে বিশ্লেষণ করলেই বিধেয়ের ধারণাটি পাওয়া যায়, সেই বচনকেই বলা হয় বিশ্লেষক বচন।
উদাহরণ:
[1] সব লাল ফুল হয় লাল।
[2] সব জড়বস্তুই হয় বিস্তারসম্পন্ন।
[3] সকল মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব ইত্যাদি।
ব্যাখ্যা: এই তিনটি উদাহরণই হল বিশ্লেষক বচনের উদাহরণ। কারণ, প্রথম
উদাহরণটির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উদ্দেশ্য তথা লাল ফুল-কে বিশ্লেষণ করলে বিধেয় তথা লাল-এর ধারণাটি এসে যায়। লালের ধারণাটি তাই লাল ফুলের মধ্যেই নিহিত। আবার দ্বিতীয় উদাহরণটির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জড়বস্তু-রূপ উদ্দেশ্যটির ধারণার মধ্যে তার বিধেয় রূপ বিস্তার-এর ধারণাটি নিহিত। জড়বস্তুর বিশ্লেষণের ফলেই তাই বিস্তারের ধারণাটিকে পাওয়া যায়। আবার তৃতীয় উদাহরণটির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, উদ্দেশ্য তথা মানুষ-এর ধারণাটি বিশ্লেষণ করলে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব-রূপ বিধেয়টি নিঃসৃত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব-এর ধারণাটি তাই মানুষের ক্ষেত্রে নতুন কিছু গুণ নয়। এ হল মানুষ-এর এক অনিবার্য গুণ যা মানুষের ধারণা থেকেই নিশ্চিতভাবে উঠে আসে। সুতরাং, এই তিনটি বচনকেই বিশ্লেষকরূপে গণ্য করা হয়।
বিশ্লেষক বচনের অন্য একটি ব্যাখ্যা:
অনেকে আবার বিশ্লেষক বচনের অন্য একটি লক্ষণ বা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। এরূপ ব্যাখ্যা বা লক্ষণের ভিত্তিতে বলা যায়-যে বচনের অন্তর্ভুক্ত শব্দগুলির অর্থের বিশ্লেষণ থেকেই বচনটির সত্যতা বা মিথ্যাত্ব জানা যায়, তাকেই বলে বিশ্লেষক বচন। অর্থাৎ, বচনটি সত্য না মিথ্যা-তা তার অন্তর্গত শব্দগুলির অর্থের মাধ্যমেই জানা যায়।
উদাহরণ:
[1] সুমিতা যদি একাদশ শ্রেণিতে পড়ে তবে সে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী।
[2] যদি A = B হয় তবে B = A।
এই দুটি উদাহরণের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, বচন দুটির অন্তর্গত যে-সমস্ত শব্দ বা পদ রয়েছে, সেগুলির সত্য বা মিথ্যা থেকেই বচন দুটির সত্য বা মিথ্যা নির্ণয় করা যায়। কারণ, বচন দুটির ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য পদ দুটি সত্য হলে বিধেয় পদ দুটিও সত্য হয়, আবার উদ্দেশ্য পদ দুটি মিথ্যা হলে বিধেয় পদ দুটিও মিথ্যা হয়। এর ফলে বচন দুটি সত্য হয় অথবা মিথ্যা হয়। অর্থাৎ বলা
যায় যে, দুটি বচনের ক্ষেত্রেই বিধেয় দুটির সত্যতা উদ্দেশ্যের সত্যতা থেকেই নিঃসৃত হয়।
বিশ্লেষক বচনের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য
বিশ্লেষক বচনের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা যায়-
[1] বিধেয়ের ধারণাটি উদ্দেশ্যের ধারণা থেকে নিঃসৃত।
[2] বিধেয়ের ধারণাটি কোনো নতুন ধারণা নয়।
[3] উদ্দেশ্যের সত্যতা থেকেই বিধেয়ের সত্যতা নির্ণয় করা যায়।
[4] উদ্দেশ্যটি যদি সত্য হয় তাহলে বিধেয়টিও সত্য হয়।
[5] উদ্দেশ্যটি যদি মিথ্যা হয় তাহলে বিধেয়টিও মিথ্যা হয়।
[6] বিশ্লেষক বচন সবসময়ই স্বতঃসত্যরূপে গণ্য হয়।
[7] এরূপ বচনের বিরুদ্ধ বিষয়টি সবসময়ই স্বতঃমিথ্যা হয়।