জল সম্পদ - জলসেচ ও জল সংরক্ষণ
- Get link
- X
- Other Apps
বিশ্ব সম্পদের ব্যবহার: জল সম্পদ- জলসেচ ও জল সংরক্ষণ (Utilization of World Resources: Water Resource-Irrigation and Water Preservation)
ভূমিকা: পর্যাপ্ত জল কৃষিব্যবস্থার এক অন্যতম উপাদান। অপরিমিত বৃষ্টিপাত ঘটলে পর্যাপ্ত জলের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে কৃষিকাজ ব্যাহত হয়। তাই অনুকূল ভূমিরূপ, উন্নতা ও মৃত্তিকার উপস্থিতি থাকলে পর্যাপ্ত জলের জোগান সুনিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম পদ্ধতিতে জলের জোগান দেওয়া হয়, যা জলসেচ ব্যবস্থা নামে পরিচিত। পৃথিবীতে বহু প্রাচীন সভ্যতায় জলসেচ পদ্ধতি প্রয়োগের নিদর্শন পাওয়া যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বর্তমানে জলসেচ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আধুনিকীকরণ ঘটেছে।
সম্পদ রূপে জল (Water as a Resource)
জীবের জীবনধারণের জন্য জল অত্যন্ত অপরিহার্য একটি উপাদান। বিভিন্ন খনিজের সমন্বয়ে সৃষ্ট জল একটি সাধারণ তরল পদার্থ। কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, মানুষের দৈনন্দিন কার্যাবলি বিশেষত পানীয় হিসেবে জলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলের এই উপযোগিতা ও কার্যকারিতার কথা বিবেচনা করে জলকে সম্পদ রূপে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে অবশ্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিশুদ্ধ জলের সংকট লক্ষ করা যাচ্ছে এবং 2025 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ এই সংকটের দ্বারা আক্রান্ত হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পৃথিবীতে জল সম্পদের বিভিন্ন রূপ ও পরিমাণ (Different States and Quantity of Water Resource in the World)
পৃথিবীতে জলের সামগ্রিক পরিমাণ 1,385,985 × 1012 ঘনমিটার।
এর মধ্যে 96.5% হল লবণাক্ত ও সামুদ্রিক জল (U.S Geological Survey-এর তথ্যানুসারে পৃথিবীতে বিপুল জলের সঞ্চয় থাকলেও তা সমুদ্রের লবণাক্ত জল)। জল বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল ও শিলামণ্ডলে যথাক্রমে তরল, গ্যাসীয় ও কঠিন রূপে অবস্থান করে। পৃথিবীর মোট জলের মধ্যে মাত্র 3% জল হল স্বাদু জল এবং এই স্বাদু জলের 99% ভূগর্ভে বা পর্বতের চূড়ায় সঞ্চিত থাকায় তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। প্রায় 1021 কেজি জল ভূপৃষ্ঠের প্রায় 71% স্থান অধিকার করে আছে, যার মাত্র 0.001% বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প হিসেবে এবং 1.6% ভৌমজল হিসেবে সঞ্চিত থাকে। মোট জলের 97% আবার সাগর-মহাসাগরে, 2.4% হিমবাহ ও আইস ক্যাপ হিসেবে এবং 0.6% নদনদী, পুকুর, হ্রদ প্রভৃতিতে অবস্থান করছে। এ ছাড়া প্রকৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্র, যেমন-শস্য, উদ্ভিদ প্রভৃতিতে খুব সামান্য জল সঞ্চিত থাকে।
জলসেচের প্রয়োগ কৌশলসমূহ (Techniques of Irrigation)
• জলসেচের সংজ্ঞা: জলসেচ হল এমন এক পদ্ধতি যা বলতে উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য যে-কোনো উপায়ে
জল প্রদানকে বোঝানো হয়। আভিধানিক অর্থে বলা যায়, জলসেচ হল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য প্রধানত খাতের মাধ্যমে ভূমি বা শস্যে জল দেওয়ার পদ্ধতি। অন্যভাবে বলা যায়, জলসেচ হল প্রয়োজনীয় সময় অন্তর উদ্ভিদকে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণ জল দেওয়ার পদ্ধতি ("Irrigation is the application of controlled amount of water to plants at needed intervals")/
• জলসেচের তাৎপর্য: জলসেচের তাৎপর্য বা গুরুত্বগুলি নিম্নরূপ- জলসেচের ফলে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি
পায়। ② অপরিমিত বৃষ্টিপাতের সময় শুষ্ক অঞ্চলে চাষ-আবাদ করা সম্ভব হয়। ③ মৃত্তিকার জমাটবদ্ধকরণকে প্রতিরোধ করে। মৃত্তিকার জলধারণ ক্ষমতা কমে গেলে সেখানে জলসেচ ব্যবস্থার প্রয়োগ প্রয়োজন হয়। (3) উচ্চফলনশীল বীজ থেকে শস্য উৎপাদনের জন্য জলসেচ অপরিহার্য। জলসেচের ফলে পৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় জলের যথাযথ অপসারণ করা সম্ভব হয়। বহু-ফসলি চাষের জন্য জলসেচ প্রয়োজন। শুষ্ক অঞ্চলে পশুপালন করার ক্ষেত্রেও অনেক সময় জলসেচ
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
• জলসেচের বিভিন্ন কৌশলসমূহ: জলসেচের বিভিন্ন কৌশল বা পদ্ধতিগুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-① মুক্ত পদ্ধতি বা বৃহৎ মাত্রার সেচ পদ্ধতি বা নালা পদ্ধতি এবং (2) বদ্ধ পদ্ধতি বা ক্ষুদ্র সেচ পদ্ধতি বা নল। পদ্ধতি।
• নিয়ন্ত্রিত জলসেচ ব্যবস্থা (Controlled Irrigation System): মুক্ত ও বন্ধ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত জলসেচ ব্যবস্থার অন্তর্গত। নিয়ন্ত্রিত জলসেচ ব্যবস্থা এমন একটি উন্নত জলসেচ ব্যবস্থা যেখানে বিদ্যুৎ বা ডিজেল চালিত যন্ত্রের সাহায্যে বিশালায়তন জমিতে সারাবছর ধরে নিয়ন্ত্রিত বা পরিমিতভাবে জল সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
মুক্ত বা নালা পদ্ধতি/বৃহৎ মাত্রার জলসেচ পদ্ধতি (Open Conduit Method/Large Scale Irrigation System)
• সংজ্ঞা: যখন এক ধরনের ফসল উৎপাদনের জন্য কোনো বিশাল আয়তনের জমিতে আল বা নালার মাধ্যমে কোনো জলাশয় বা কোনো নদীর জল সরবরাহ করা হয়, তখন তাকে মুক্ত বা নালা পদ্ধতি বা বৃহৎ মাত্রার সেচ পদ্ধতি বলা হয়।
শ্রেণিবিভাগ: বৃহৎ মাত্রার সেচ ব্যবস্থা দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত-① পৃষ্ঠীয় জলসেচ ব্যবস্থা (Surface Irriga-
tion Stystem) ও উপপৃষ্ঠীয় জলসেচ ব্যবস্থা (Subsurface Irrigation System) | • পৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় জলসেচ ব্যবস্থার ধারণা: বিভিন্ন জলাশয় থেকে পাম্প দিয়ে জল তুলে, সেচ খালের জল জমির উপর দিয়ে চালনা করে অথবা নলকূপ বা কূপের সাহায্যে (ভৌমজল কৃষিজমির উপর প্রবাহিত করাকে পৃষ্ঠীয় ও উপপৃষ্ঠীয় জলসেচ ব্যবস্থা বলা হয়।
• মুক্ত বা নালা পদ্ধতি/বৃহৎ মাত্রার জলসেচ পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশল:
• খাল জলসেচ পদ্ধতি (Canal Irrigation Method):
সংজ্ঞা: স্বল্প ভূমিঢাল সম্পন্ন কৃষি জমির কাছে বিভিন্ন
জলাশয়, যেমন-নদী, হ্রদ প্রভৃতি থাকলে সেখানকার জল খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হয়। এই জলসেচ পদ্ধতিকে খাল জলসেচ পদ্ধতি বলা হয়।
• শ্রেণিবিভাগ: খাল জলসেচ পদ্ধতিতে জলের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে দুই ধরনের খালের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
• প্লাবন খাল (Inundation Canal): নদী থেকে একটি সুনিদিষ্ট উচ্চতায় খাল খনন করে বর্ষার অতিরিক্ত জলকে ওই খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হলে তাকে প্লাবন খাল বলে। ভারতের দক্ষিণাংশে এই খাল লক্ষ করা যায়। সাধারণত শুষ্ক ঋতুতে বা বৃষ্টির পরিমাণ কম থাকলে এই খালে জল থাকে না। প্রধানত বর্ষার জোয়ারের ফলে বা বর্ষার সময় বন্যা হলে প্লাবন খালে জল থাকে।
নিত্যবহ বা স্থায়ী খাল (Perennial Canal): নিত্যবহ নদী বা পার্বত্য অঞ্চলে নদীর ওপরে আড়াআড়ি
ভাবে বাঁধ নির্মাণ করে সৃষ্ট জলাধার থেকে যে খাল খনন করা হয়, তাকে নিত্যবহ বা স্থায়ী খাল বলে। ভারতে বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনা কার্যকরী হওয়ার ফলে নিত্যবহ বা স্থায়ী খালের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরনের খালে সারাবছর জল থাকে।
• খাল জলসেচ পদ্ধতির গুরুত্ব: (i) পতিত জমিকে খাল জলসেচের মাধ্যমে কৃষিজমিতে পরিণত করা সম্ভব হয়। যেমন-রাজস্থানের এক বিশালায়তন অব্যবহৃত জমিতে ইন্দিরা গান্ধি
ক্যানেল-এর মাধ্যমে শস্য উৎপাদন করা হচ্ছে। (ii) এই পদ্ধতির সাহায্যে এক বিশাল আয়তন বিশিষ্ট জমিতে জলসেচ করা সম্ভব। (iii) খালের জল থেকে কিছু পরিমাণ জল ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে, যার ফলে ভৌমজলের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ হয়। (iv) খালের জলে নদীর পলি এসে জমা হয় এবং এই পলি চাষের জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। (v) সারাবছরব্যাপী সেচের জল পাওয়া যায় বলে এই পদ্ধতির সাহায্যে খরার সময়েও ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হয়। (vi) খাল খনন করার প্রাথমিক ব্যয় যথেষ্ট বেশি হলেও সারাবছর বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। (vii) জলসেচ পদ্ধতির সাহায্যে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।
• সমস্যা: (১) শুষ্ক সময়ে জলাধার, নদী প্রভৃতিতে জলের পরিমাণ কমে গেলে জলসেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। (ii) বর্ষাকালে জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে বন্যা হয়ে থাকে। (iii) ভূ-অভ্যন্তরের নোনা জল খালের জলের সঙ্গে মিশ্রিত হলে মাটি লবণাক্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যায়। ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রে এই সমস্যা লক্ষ করা যায়। (iv) খাল তৈরির প্রাথমিক ব্যয় যথেষ্ট বেশি এবং এর ফলে প্রচুর জমি নষ্ট হয়ে থাকে। (v) পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলে খাল সেচ পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। (vi) খাল সংলগ্ন জলমগ্ন স্থানে মশা সহজেই বংশবৃদ্ধি করে এবং ম্যালেরিয়াজনিত সমস্যা লক্ষ করা যায়।
• খাত রেখা জলসেচ পদ্ধতি (Furrow Irrigation Method): সংজ্ঞা: এই পদ্ধতিতে প্রশস্ত প্রধান নালা খনন করা হয় এবং ওই খালের দুইপাশে বা একপাশে সমান ঢালযুক্ত যে চাষযোগ্য জমি থাকে সেখানে প্রধান নালা থেকে সৃষ্ট অসংখ্য ছোটো নালা দ্বারা জলের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়।
• শ্রেণিবিভাগ: খাত রেখা জলসেচ পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ করা যায় যথা- (a) সমান্তরাল সরল সমতল খাত সেচ (Straight Level Furrow): সমতল ও ক্ষুদ্র জমিতে লক্ষ করা যায়। (b) সরল উতরাই খাত সেচ (Straight Graded Furrow): ঢালযুক্ত ও বিশালায়তন জমিতে মৃত্তিকার ক্ষয় প্রতিরোধের জন্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। (c) উচ্চস্তরীয় খাত সেচ (Raised Bed Furrow): দুটি খাতের মধ্যবর্তী জমিকে প্রশস্ত ও উঁচু করে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। (d) পর্যায়ক্রমিক খাত সেচ (Alternate Furrow): শুষ্ক ও লবণাক্ত মৃত্তিকাযুক্ত অঞ্চলের খাতগুলিকে পরপর কিছুদিন জলপূর্ণ করে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। (e) তরঙ্গায়িত খাত সেচ (Corragation Furrow): যেসব অঞ্চলে কাঁকরযুক্ত মাটি লক্ষ করা যায়, সেখানে পরস্পর সংলগ্ন ভাবে দানাশস্য চাষের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যায়।
বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ: (a) নালার ঢাল (Slope of Conduit): জলের গতিবেগ ও মৃত্তিকার প্রবণতার দ্বারা প্রধান নালার অনুদৈর্ঘ্য ঢালের প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। (b) নালার গঠন (Structure of Conduit): বেশি ঢালযুক্ত জমিতে নালাগুলি সাধারণত তির্যকভাবে অবস্থান করে। নালার গঠন মূলত নির্ভর করে শস্যের প্রকৃতি ও ভূমির ঢালের ওপরে। (c) অনুপ্রবেশের মাত্রা (Level of Infiltration): মৃত্তিকার গঠন ও প্রকৃতির ওপর জলের অনুপ্রবেশের মাত্রা নির্ভর করে। যেমন-এঁটেল মাটিতে জলের অনুপ্রবেশের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম হয়ে থাকে। (d) নালার বিস্তার (Extension of Conduit): শ্রমিকদের সেচ পদ্ধতি সংক্রান্ত ধারণা, কর্মদক্ষতা ও মৃত্তিকার প্রবেশ্যতার ওপর প্রধান নালার বিস্তার নির্ভর করে। (e) ফসলের প্রকৃতি (Nature of Crops): খাত রেখা জলসেচ পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণত আখ, কার্পাস ইত্যাদি
এমন কিছু ফসল চাষ করা হয়, যাদের জলের চাহিদা কম। আলু, ভুট্টা প্রভৃতি ফসল এই পদ্ধতির সাহায্যে উৎপাদন করা হয়। • অববাহিকা বা বেসিন বা চেক জলসেচ পদ্ধতি (Basin or Check Irrigation Method): সংজ্ঞা: যে
পদ্ধতিতে ক্ষুদ্রায়তন জমির চারদিকে উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলে তার ভিতরে জলসেচ করা হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্তিকার ভিতরে জলের অনুপ্রবেশ না ঘটছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই অববাহিকার ভিতরেই জলকে আবন্ধ করে রাখা হয়, সেই পদ্ধতিকে অববাহিকা বা বেসিন বা চেক জলসেচ পদ্ধতি বলে।
• শ্রেণিবিভাগ: অববাহিকা বা বেসিন জলসেচ পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- (a) সমোন্নতি বেসিন জলসেচ পদ্ধতি (Contour Basin Irrigation Method): এক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চলের ঢালু ভূমিভাগে সমোন্নতি রেখা অনুযায়ী লম্বা আকারের অববাহিকা তৈরি করা হয়। (b) বর্গাকার বেসিন জলসেচ পদ্ধতি (Square Basin Irrigation Method): এক্ষেত্রে সমতল কৃষিজমিকে আয়তক্ষেত্র বা বর্গক্ষেত্রের আকারে বিভক্ত করা হয়।
• বিশেষ বৈশিষ্ট্য: (1) অববাহিকা জলসেচ পদ্ধতির সাহায্যে প্রধানত ফল উৎপাদন করা হয়। (ii) জলপ্রবাহকারী খালের গভীরতা ও নদীর বিন্যাসের ওপর এই পদ্ধতি অনেকাংশে নির্ভর করে। (ii) তা ছাড়া, অববাহিকার আকৃতি ও মৃত্তিকার ধর্মও অববাহিকা বা চেক জলসেচ পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
• সমস্যা: (i) এক্ষেত্রে মৃত্তিকা অত্যন্ত শক্ত প্রকৃতির হওয়ায় প্রায়ই কর্ষণের প্রয়োজন পড়ে। (ii) এই পদ্ধতি সব ধরনের ফসল উৎপাদনে সহায়ক নয়, কারণ এক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় জল জমা হয়ে থাকে।
• কিনারা জলসেচ পদ্ধতি (Border Irrigation Method): সংজ্ঞা: যে পদ্ধতিতে আল দ্বারা সেচের জলকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং দুটি আলের মাঝখানের সমতল জমিতে জলের জোগান দেওয়া হয়, তাকে কিনারা জলসেচ পদ্ধতি বলে।
শ্রেণিবিভাগ: কিনারা জলসেচ পদ্ধতিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- (a) সমোন্নতি রেখা সীমানা ফালি সেচ (Con- tour Border Strip Irrigation): পাহাড়ি ও মালভূমি অঞ্চলের ভূমিক্ষয় রোধের জন্য কৃষিজমিতে সমোন্নতি রেখা অনুসরণ করে ফালি তৈরি করে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়। এই জলসেচের সাহায্যে ডাল, ভুট্টা, তামাকের চাষ করা হয়। (৮) সরল সীমানা ফালি সেচ (Straight Border Strip Irrigation): মৃদু ঢালু বা প্রায় সমতল কৃষিজমিকে লম্বা ফালিতে ভাগ করা হয় এবং দুটি ফালির মাঝখানের অংশে জলসেচ করা হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে ওট, বিট, গম প্রভৃতি উৎপাদন করা হয়।
সমস্যা: (i) এই পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত ঢালু, সুদীর্ঘ ও আয়তাকার জমি পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায়। (ii) কিনারাতে জল নিষ্কাশন না করা হলে ভূমিক্ষয় ঘটে থাকে। নিউজিল্যান্ডে এই সেচ ব্যবস্থা যথেষ্ট প্রচলিত।
• প্লাবন জলসেচ পদ্ধতি (Flood Irrigation Method): সংজ্ঞা: এই জলসেচ পদ্ধতিতে জমির উপর যাতে জল দাঁড়িয়ে থাকে তার জন্য বিশালায়তন জমিতে খাল বা নদী, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় থেকে জল তুলে অথবা ভৌমজল তুলে জমিটিকে পূর্ণ করা হয়। ধান জাতীয় যেসব ফসল চাষের ক্ষেত্রে জমিতে জল দাঁড়িয়ে থাকা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে প্লাবন জলসেচ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
• বেসিন ও বলয় জলসেচ পদ্ধতি (Basin and Zone Irrigation Method): সংজ্ঞা: হটিকালচার বা ফুল, সবজি, ফল প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য গাছের গোড়ায় বর্গাকৃতি বা গোলাকৃতির বেসিন বা বলয় তৈরি করা হয় এবং প্রধান খাল সংলগ্ন শাখা খাল থেকে জল সরবরাহ করা হয়। • স্থির-সমতলীয় জলসেচ পদ্ধতি (Dead Level Irrigation Method):
সংজ্ঞা: এই জলসেচ পদ্ধতিতে কৃষিজমির সব জায়গায় জল সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জমিকে সমতল করে জমিতে আল দিয়ে আবন্ধ করা হয়, যাতে সেচের জল একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। প্রধানত ধান চাষের ক্ষেত্রে এই জলসেচ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
জলসেচে জলের ব্যবহার ও অপব্যবহার (Use and Misuse of Water in Irrigation)
জলসেচে জলের ব্যবহার (Use of Water in Irrigation)
(i) চারাগাছের বৃদ্ধি: সুনির্দিষ্ট সময়ের ভিত্তিতে চারাগাছের বৃদ্ধি ও বিকাশ সুষ্ঠুভাবে হওয়ার জন্য পরিমিত পরিমাণ জল প্রয়োজন।
(ii) অঙ্কুরোদ্গম প্রক্রিয়া: কৃষিজমিতে বীজ বপন করার পরে তা থেকে অঙ্কুরোদ্গমের জন্য যথাযথ মাত্রায় জল দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
(iii) ফসল উৎপাদনের জন্য জলের জোগান: ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত জলের প্রয়োজন। কৃষিক্ষেত্রে জলের জোগান অব্যাহত রাখার জন্য মিশরে নীলনদের
ওপর এবং ভারতে দামোদর পরিকল্পনা, ভাকরা-নাঙ্গাল প্রকল্প প্রভৃতি বহুমুখী নদী-উপত্যকা পরিকল্পনা গড়ে তোলা হয়েছে।
(iv) সার ব্যবহার: সেচের জলের সাহায্যে কৃষিজমিতে সার ব্যবহার করা যথেষ্ট সহজসাধ্য হয়। লবণাক্ততার প্রভাব হ্রাস: সেচের জলের সাহায্যে মাটির উপরিভাগে সঞ্চিত লবণের অপসারণ ঘটে।
(Vi) জলবিদ্যুৎ উৎপাদন: জলসেচের জন্য তৈরি বাঁধের পিছনে সঞ্চিত জলে টারবাইন ঘুরিয়ে যথেষ্ট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
(Vii) পানীয় জলের জোগান: সেচের জন্য ব্যবহৃত জলকে বিশুদ্ধ করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
(Viii) পরিবহণের মাধ্যম: জলসেচের উদ্দেশ্যে জলাধার থেকে নির্মিত খালকে জলপথ রূপেও ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ: দুর্গাপুর ব্যারেজের বামতীরে অবস্থিত খালটি জলপথে পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
(ix) মাছ উৎপাদন: পাঞ্চেৎ, মাইথন প্রভৃতি বাঁধের পিছনে সেচের জন্য নির্মিত জলাশয়ের জলে মাছ উৎপাদন করা হয়।
জলসেচে জলের অপব্যবহার (Misuse of Water in Irrigation)
(i) অতিরিক্ত ব্যবহার: অনেক ক্ষেত্রেই যে পরিমাণ জল ফসলের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন তার থেকে বেশি জল সরবরাহ করা হয়। শুষ্ক অঞ্চলের ফসলের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি লক্ষ করা যায়।
(ii) মৃত্তিকাক্ষয়ের সমস্যা: কৃষিজমিতে জল স্থির না থেকে তীব্রগতিতে প্রবাহিত হলে মৃত্তিকাক্ষয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
(iii) বন্যার সমস্যা: অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত বাঁধ অনেক সময় বর্ষার অতিরিক্ত জলের প্রভাবে ভেঙে যায় এবং বন্যার সমস্যা দেখা দেয়।
(iv) জলদূষণের সমস্যা: জলসেচের জন্য অতিরিক্ত হারে ভৌমজল তোলার ফলে ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যায় এবং আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
(v)গবাদিপশুর ক্ষেত্রে ব্যবহার: গবাদিপশুর স্নানের জন্য সেচের জল ব্যবহার করা হলে জলের গুণগত মানের অবনতি ঘটে।
(Vi) জল সম্পদ হ্রাস: সেচকার্যে জলের অপব্যবহারের ফলে সামগ্রিক ভাবে জল সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পায়।
অধিক জলসেচের বিপদ (Dangers of Overwatering in Irrigation)
প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পরিমাণে জলসেচের ফলে শস্য উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি মৃত্তিকার স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে। অধিক জলসেচজনিত বিপদগুলিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ-এই দুটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
• প্রত্যক্ষ বিপদ: কৃষিজমির গুণগত মানের অবনমন জলসেচের সুবিধা থাকায় সারাবছরব্যাপী ফসল
উৎপাদনের ফলে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পায়। অক্সিজেনের ঘাটতি: অতিরিক্ত জলসেচের ফলে ভূমি জলমগ্ন হয়ে পড়ে এবং জলমগ্ন মৃত্তিকায় অক্সিজেনের ঘাটতি থাকায় উদ্ভিদের মূল পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। উদ্ভিদের বৃদ্ধিজনিত সমস্যা: জলমগ্ন ভূমিভাগে শক্তির পরিবহণ কম হওয়ায় উদ্ভিদের বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সমস্যা লক্ষ করা যায়। উদ্ভিদের শিকড়ের রোগ: জলমগ্ন মৃত্তিকায় জীবাণুর ক্রিয়াশীলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্ভিদের শিকড়ে পচন রোগ জনিত সমস্যা দেখা যায়। উদ্ভিদের অন্যান্য রোগ: জলমগ্ন ভূমিভাগে উদ্ভিদ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। উপকারী প্রাণীর মৃত্যু: অতিরিক্ত মাত্রায় জলসেচের ফলে মাটির বিভিন্ন উপকারী প্রাণী, যেমন-ব্যাকটেরিয়া, কেঁচো প্রভৃতির মৃত্যু হয়। মৃত্তিকার তাপমাত্রা হ্রাস: অধিকমাত্রায় জলসেচের কারণে মাটির তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং এর ফলস্বরূপ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও ব্যাকটেরিয়া কার্যকলাপ ব্যাহত হয়। বিষাক্ত পদার্থ সৃষ্টি: দীর্ঘ সময় ধরে মাটি জলমগ্ন থাকার ফলে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ যেমন-ভোলাটাইল ফ্যাটি অ্যাসিড (Volatile Fatty Acid), হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতি উৎপন্ন হয়। • জলদূষণের সমস্যা: ভূমিতে অতিরিক্ত জলসেচের ফলে জলপ্রবাহের সঙ্গে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ধুয়ে গিয়ে সংলগ্ন জলাশয়ে এসে পড়ে এবং জলদূষণ ঘটায়।
পরোক্ষ বিপদ: লবণাক্ততার সমস্যা: অধিক জলসেচের
কারণে মাটির নীচের স্তর থেকে লবণ কৈশিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির উপরিস্তরে এসে সঞ্চিত হয় এবং ফলস্বরূপ মৃত্তিকা ক্ষারকীয় হয়ে পড়ে ও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস: অতিরিক্ত মাত্রায় ভৌমজল উত্তোলনের ফলে ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাস পায় এবং শুষ্ক ঋতুতে জল পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায়। • পানীয় জলের ঘাটতি : ভৌমজলের পরিমাণ হ্রাসের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পানীয় জলের ঘাটতিজনিত সমস্যা লক্ষ করা যায়। • উদ্ভিদের বিনাশ : ভৌমজলস্তরের উচ্চতা হ্রাসের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং উদ্ভিদের মৃত্যু ঘটে। ভূমির অবনমন : অধিক মাত্রায় জলসেচের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভৌমজল উত্তোলন করায় ভূগর্ভে শূন্যস্থান তৈরি হয় এবং সেখানে জলের চাপ হঠাৎ হ্রাস পেলে উপরের ভূমিভাগের অবনমন ঘটে।
জল সম্পদ সংরক্ষণ ও জলবিভাজিকার ব্যবস্থাপনা (Conservation of Water Resources
and Watershed Management)
পৃথিবীর সাগর ও মহাসাগরগুলিতে জল সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রায় 97% ও স্বাদু জলের পরিমাণ মাত্র 3%। এই স্বাদু জলের আবার 69% হিমবাহ ও বরফের চাদরে সঞ্চিত আছে এবং প্রায় 30% ভৌমজল হিসাবে সঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় 0.9% জলের 87% হ্রদে, 11% জলাভূমিতে এবং 2% নদনদীতে সঞ্চিত আছে। পৃথিবীতে জল হল এমন একটি উপাদান, যা তরল, কঠিন ও বাষ্পীয়-এই তিন অবস্থাতেই থাকতে পারে। পর্যাপ্ত মাত্রায় জলের অভাবে জীবজগতের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা যায় এবং বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলসম্পদের প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে সমস্যা লক্ষ করাও যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জল সংরক্ষণ ও জলবিভাজিকার ব্যবস্থাপনাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জল সম্পদ সংরক্ষণ (Conservation of Water Resources)
জলবিভাজিকা ব্যবস্থাপনা (Watershed Management)
- Get link
- X
- Other Apps