আধুনিক ইউরোপ তথা বিশ্বের ইতিহাসে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনায়ক যিনি এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও নিজ প্রতিভার গুণে ফ্রান্সের চূড়ান্ত শাসনক্ষমতা দখল করেন। ঐতিহাসিক ফিলিপ গুয়েদালা বলেছেন যে, "নেপোলিয়নের উত্থানের ফলে ফ্রান্সের ইতিহাস হয় ইউরোপের ইতিহাস এবং নেপোলিয়নের ইতিহাস হয় ফ্রান্সের ইতিহাস"।
|
নেপোলিয়ন কীভাবে ফ্রান্সের ক্ষমতা লাভ করেন? |
নেপোলিয়নের উত্থান ও ক্ষমতালাভ
[1] উত্থান: ফরাসি বিপ্লবের ঘটনা নেপোলিয়নের উত্থানের ভিত গড়ে দেয়। এই বিপ্লবই তাঁকে জীবন পথের সন্ধান দেয়। তিনি বিপ্লবপন্থী জ্যাকোবিন দলের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেকে ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে তুলে ধরেন। বিপ্লবের পর নেপোলিয়ন মাত্র ১৭ বছর বয়সে ফরাসি গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে নিযুক্ত হন।
[2] অভ্যন্তরীণ সাফল্য: লেফটেন্যান্ট পদে বসে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য পান। এই সময়- [i] ইংরেজ বাহিনীর অবরোধ থেকে ফ্রান্সের তুলো বন্দর মুক্ত (১৭৯৩ খ্রি.) করে সামরিক সাফল্য দেখিয়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের পদে উন্নীত হন। [ii] তিনি উন্মত্ত জনতার আক্রমণ থেকে ফরাসি জাতীয় সভাকে রক্ষা করেন (১৭৯৫ খ্রি.) এটি 'ভঁদেমিয়ার ঘটনা' নামে পরিচিত। এই সাফল্যের পুরস্কারস্বরূপ তিনি মেজর জেনারেল পদ লাভ করেন।
[3] সামরিক সাফল্য: ডাইরেক্টরির শাসনকালে (১৭৯৫-৯৯ খ্রি.) নেপোলিয়ন [1] ইটালির সার্ভিনিয়া, পার্মা, মডেনা ও নেপলসকে পরাজিত করেন। [ii] অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে মিলান-সহ ইটালির বিভিন্ন স্থান ফ্রান্সের দখলে আনেন এবং পরে অস্ট্রিয়াকে ক্যাম্পো ফর্মিও-এর সন্ধি (১৭৯৭ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। [iii] পোপের রাজ্য আক্রমণ করে পোপকে টলেন্টিনা-র সন্ধি (১৭৯৭ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য করেন। [iv] ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পিরামিডের যুদ্ধে (১৭৯৮ খ্রি.) জয়লাভ করলেও নীলনদের যুদ্ধে (১৭৯৮ খ্রি.) পরাজিত হন।
আরও পড়ুন:-
[4] ক্ষমতা দখল: ডাইরেক্টরির শাসনকালে ফ্রান্সে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে এই শাসনব্যবস্থার প্রতি ফরাসি জনগণ অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নেপোলিয়ন সেনাবাহিনীর সহায়তায় ডাইরেক্টরির শাসকদের পদচ্যুত করে (৯ নভেম্বর, ১৭৯৯ খ্রি.) ফ্রান্সে 'কনসুলেট' নামে এক নতুন শাসনব্যবস্থা চালু করেন। তিনি নিজে প্রধান কনসালের দায়িত্ব নেন এবং আরও ২ জন সহযোগী কনসাল নিয়োগ করে শাসন চালাতে থাকেন।
[5] চূড়ান্ত ক্ষমতা: নেপোলিয়ন প্রথমে ১০ বছরের জন্য এবং পরে সংবিধান সংশোধন করে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে আজীবন কনসাল পদ লাভ করেন। ফলে ফরাসি শাসনব্যবস্থায় তাঁর শক্তি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।
এই অবস্থায় তিনি ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে 'সম্রাট' উপাধি গ্রহণ করেন এবং মাত্র ৩০ বছর বয়সে ফ্রান্সে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
মূল্যায়ন: ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আদর্শকে জনগণের সামনে তুলে ধরে নেপোলিয়ন ক্ষমতা হস্তগত করলেও পরবর্তীকালে তিনি জনগণের
স্বাধীনতার অধিকারটি ধূলিসাৎ করেন। অবশ্য জনগণকে সাম্য ও মৈত্রীর অধিকার দিয়ে তিনি দেশবাসীর ক্ষতি কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা করেন। তিনি দেশে চূড়ান্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁর শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ও সামরিক সাফল্যে দেশবাসী মুগ্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে বিরত ছিল।