বিভিন্ন ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন-কয়লা, খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি দহন করে যে তাপশক্তি পাওয়া যায়, তার মাধ্যমে জলকে বাষ্পে রূপান্তরিত করা হয় এবং ওই বাষ্পশক্তির সাহায্যে টারবাইন ঘুরিয়ে যে গতিশক্তি উৎপন্ন হয় তাকে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করা হয়ে থাকে, যা তাপবিদ্যুৎ নামে পরিচিত।
তাপবিদ্যুৎ শক্তির প্রকারভেদ:
তাপবিদ্যুৎ শক্তিকে জ্বালানির উপর নির্ভর করে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়- কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ শক্তি, খনিজ তেল ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ শক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ শক্তি। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল থেকে সৃষ্ট বিদ্যুৎশক্তিকে গ্যাস-নির্ভর বিদ্যুৎ ও ডিজেল-নির্ভর বিদ্যুৎ বলা যেতে পারে।
ভৌগোলিক নিয়ন্ত্রকসমূহ:
জ্বালানির প্রাপ্যতা: কয়লা, খনিজতেল, প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতার
ওপর ভিত্তি করে তাপবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদিত হয়। যেমন-ভারতের পূর্বদিকে ঝরিয়া, রানিগঞ্জ, আসানসোল প্রভৃতি অঞ্চলের কয়লাখনিগুলির ওপর ভিত্তি করে দুর্গাপুর, ব্যান্ডেল, কোলাঘাট প্রভৃতি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকাশ ঘটেছে। বিস্তৃত জমি: কয়লা দহনের ফলে উৎপন্ন ছাই ফেলার জন্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে বিস্তৃত জমি থাকা জরুরি। পর্যাপ্ত জলের জোগান: তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি সাধারণত জলাশয়ের কাছাকাছি গড়ে ওঠে, কারণ উত্তপ্ত যন্ত্রপাতি ঠান্ডা করা এবং টারবাইন ঘোরানোর জন্য প্রয়োজনীয় বাষ্পশক্তি উৎপাদনের জন্য, পর্যাপ্ত জলের জোগান থাকা দরকার। মূলধন বিনিয়োগ: তাপবিদ্যুৎ শক্তি কেন্দ্রে কাঁচামালের জোগান ও তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করার প্রয়োজন হয়। আধুনিক প্রযুক্তি: স্বল্প খরচে অধিক মাত্রায় উৎপাদনের জন্য এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
পরিবেশ-মিত্র প্রযুক্তির প্রয়োগ: পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যা প্রতিরোধের জন্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিবেশ-মিত্র প্রযুক্তির ব্যবহার করা উচিত। যেমন-ফুয়েল গ্যাস ট্রিটমেন্ট-এর সাহায্যে পৃথিবীতে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎপন্ন ছাই ও ধোঁয়া সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। বিস্তৃত বাজার: পরিমাণ (2016): উৎপন্ন ছাই ও ধোঁয়া সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। বিস্তৃত বাজার: তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিস্তৃত বাজারের অবস্থান থাকা প্রয়োজন। বাজার ও উৎপাদনকেন্দ্রের মধ্যে স্বল্প দূরত্ব: বিদ্যুৎ-এর অপচয় কমানোর জন্য বাজার ও উৎপাদনকেন্দ্রের মধ্যে স্বল্প দূরত্ব থাকা প্রয়োজন। বিকল্প শক্তির ঘাটতি: বিকল্প শক্তির ঘাটতি থাকায় তাপবিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারি সহযোগিতা: অনুকূল সরকারি নীতি ও সরকারি তরফে বিনিয়োগ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকাশে সাহায্য করে।
বিশ্বের প্রেক্ষিতে ভারত (India in World Respect) : 2016 খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুসারে চিন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। উপরোক্ত এই তিনটি দেশেই কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। ভারতে 2016 খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুসারে, মোট উৎপাদিত তাপবিদ্যুতের পরিমাণ 218329.88 মেগাওয়াট (MW) (68.31%), যার মধ্যে 192168.88 MW (60.13%), 25,329.38 MW (7.95%) ও 837.63 MW (0.26%) তাপবিদ্যুৎ যথাক্রমে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও ডিজেল থেকে উৎপন্ন হয়।
কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ: ভারতে মোট বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় 62%-এর অধিক পূরণ করা সম্ভব হয়, দেশের কয়লা ভাণ্ডারের সাহায্যে। এই দেশে সরকারি National Thermal Power Corporation (NTPC) ও বিভিন্ন রাজ্যস্তরের বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থা এবং কিছু বেসরকারি সংস্থা কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতে বর্তমানে প্রায় 116টি কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ: 2016 খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুসারে ভারতে প্রাকৃতিক গ্যাস-নির্ভর
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির উৎপাদক্ষমতা হল প্রায় 24508.63 মেগাওয়াট (MW)। বর্তমানে ভারতে প্রায় 65টি প্রাকৃতিক গ্যাস-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
ডিজেল/খনিজ তেল-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র: ভারতে 2016 খ্রিস্টাব্দের তথ্য অনুসারে ভারতে ডিজেল-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় 993.53 মেগাওয়াট (MW) এবং মোট ডিজেল-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা হল প্রায় 19টি।
তাপবিদ্যুৎ শক্তির সুবিধা: (1) তাপবিদ্যুৎ প্রধানত কয়লা ও খনিজ তেল উত্তোলক যে-কোনো অঞ্চলের কাছে বা দূরে উৎপাদন করা যেতে পারে। (2) এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ব্যয় যথেষ্ট কম হওয়ায় উন্নয়নশীল দেশেও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। (3) তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্রা চাহিদার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। (4) প্রচলিত শক্তি হওয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গঠন ও তা থেকে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি যথেষ্ট সহজলভ্য।
তাপবিদ্যুৎ শক্তির সমস্যা: তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল সংগ্রহের ব্যয় যথেষ্ট বেশি। ② তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের ভাণ্ডার বারংবার ব্যবহারের ফলে নিঃশেষিত হয়ে যায়। ③ কাঁচামালের পরিমাণগত ও গুণগত মান বজায় না থাকলে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা ঘটে। এ অনেক সময় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটায় বহু মানুষ ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে পরিবেশদূষণের মাত্রা যথেষ্ট বেশি থাকে।